নিজস্ব প্রতিবেদক বিডি-অনলাইন ম্যাগাজিন ডটকম,
Published Sat Jul 12, 2025, 2, 35, am
-
গত বছরের জুলাই-আগস্টে ফ্যাসিস্টবিরোধী ৩৬ দিনের আন্দোলন দমনে পরিকল্পনা এবং পুলিশকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশদাতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার দিন রাজধানী ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে প্রকৃতপক্ষে কয়জন আন্দোলনকারী প্রাণ হারিয়েছিলেন, তা নিয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে বিবিসির হাতে যেসব প্রমাণ (ছবি, ভিডিও, ড্রোন ভিডিও, অডিও রেকর্ড, গণমাধ্যম কাটিং, ফুটেজ ও সাক্ষাৎকার) এসেছে, তাতে দেখা গেছে, আন্দোলনকারীদের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র প্রয়োগের নির্দেশদাতা ছিলেন শেখ হাসিনা।
এ ছাড়া বিবিসি দাবি করেছে, আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ফাঁস হওয়া অডিও টেপটি যে মোটেও নকল নয়, সেটিও বিবিসির গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। বিবিসি এটাও দাবি করেছে, গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল সেদিন (৫ আগস্ট) যাত্রাবাড়ীতে মোট ৩০ জন আন্দোলনকারী প্রাণ হারান।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেদিন মোট ৫২ জন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন।
উল্লেখ্য, বিবিসি আই ইনভেস্টিগেশনসের প্রতিবেদনটির শিরোনাম হচ্ছে, ‘ফাঁস হওয়া অডিও মতে, প্রাক্তন বাংলাদেশি নেতাই প্রাণঘাতী দমন-পীড়নের অনুমোদন দিয়েছিলেন’। অন্যদিকে বিবিসি বাংলার করা একই প্রতিবেদনের শিরোনাম হচ্ছে, ‘বিবিসির অনুসন্ধানে ৫ আগস্ট ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে পুলিশি হত্যাকাণ্ডের যে চিত্র উঠে এসেছে’। বিবিসি আই ইনভেস্টিগেশনসের ইংরেজি প্রতিবেদনে যে প্রসঙ্গটিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে তা করা হয়নি।
বরং গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিবেদনটি মূল অংশটি নিচের দিকে বেশ মোলায়েমভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
এদিকে বিবিসির এই ডকুমেন্টারি প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন ও প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা আসিফ নজরুল গতকাল বুধবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে বলেছেন, ‘শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ যে তিনি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে বিক্ষোভকারীদের গুলি করার জন্য সরাসরি অনুমতি দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার উপযুক্ত বিচার অবশ্যই হবে বাংলাদেশে।’
বিবিসির মূল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথোপকথনের ফাঁস হওয়া একটি অডিও রেকর্ডিং থেকে জানা যায়, গত গ্রীষ্মে প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের অনুমতি তিনি নিজেই দিয়েছিলেন।
বিবিসির যাচাই করা ওই রেকর্ডিং অনুসারে, শেখ হাসিনা তাঁর নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে ‘প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার’ করার অনুমতি দিয়েছেন এবং ‘তাঁরা (এসব বাহিনীর সদস্যরা) যেখানেই তাঁদের (আন্দোলনকারী) পাবেন, তাঁরা গুলি করবেন।’ অজ্ঞাত একজন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে শেখ হাসিনার কথোপকথনের ফাঁস হওয়া অডিওটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ যে তিনি সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের গুলি করার জন্য সরাসরি অনুমতি দিয়েছিলেন। ফাঁস হওয়া অডিওটি সম্পর্কে জানেন এমন একটি সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছেন, গত ১৮ জুলাই নিজের সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে শেখ হাসিনা ওই ফোনালাপটি করেন। ফাঁস হওয়া রেকর্ডিংয়ের কণ্ঠের সঙ্গে শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বরের মিল শনাক্ত করেছে বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ। অন্যদিকে বিবিসি আলাদাভাবে ইয়ারশটের অডিও ফরেনসিক এক্সপার্টদের দিয়ে এই রেকর্ডিংয়ের সত্যতা যাচাই করেছে এবং তারা এটিতে এডিট করার বা কোনো রকম পরিবর্তন করার কোনো প্রমাণ পায়নি।
এদিকে বিবিসির অনুসন্ধানে গত বছরের ৫ আগস্ট ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে পুলিশি হত্যাকাণ্ডের নতুন ধারণা উঠে এসেছে। এতে দেখানো হয়েছে, সেদিন যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে মোট ৫২টি প্রাণ ঝরে পড়ে, যা ধারণার চেয়েও অনেক বেশি। ঘটনাটিকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ পুলিশি সহিংসতাগুলোর একটি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। গত বছর সরকারবিরোধী বিক্ষোভের শেষ দিনে ভয়াবহ ঘটনাটি কিভাবে ঘটেছিল, সেটি বের করার জন্য তখনকার শত শত ভিডিও, ছবি ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যগ্রহণ এবং সেগুলো বিশ্লেষণের পাশাপাশি সরেজমিনে বেশ কয়েকবার যাত্রাবাড়ীর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বিবিসি।
জাতিসংঘের প্রতিবেদন ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে নানা খবর প্রকাশিত হলেও নির্বিচারে হত্যার ঘটনাটি কিভাবে শুরু ও শেষ হয়েছিল এবং তাতে কত মানুষ হতাহত হয়েছিল, সে সম্পর্কে বিবিসির অনুসন্ধানে এমন কিছু তথ্য ও বিবরণ উঠে এসেছে, যা আগে সেভাবে সামনে আসেনি।
পৃলিশ বাহিনীর একজন মুখপাত্র ঘটনা স্বীকার করে বিবিসিকে বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় এ ধরনের দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে, যেখানে তৎকালীন পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্য অতিরিক্ত বল প্রয়োগে লিপ্ত হয়েছিলেন এবং আন্দোলনকারীদের নিয়ন্ত্রণে অপেশাদার আচরণ করেছিলেন।’
জাতিসংঘের প্রতিবেদন ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে নানা খবর প্রকাশিত হলেও নির্বিচারে হত্যার ঘটনাটি কিভাবে শুরু ও শেষ হয়েছিল এবং তাতে কত মানুষ হতাহত হয়েছিল, সে সম্পর্কে বিবিসির অনুসন্ধানে এমন কিছু তথ্য ও বিবরণ উঠে এসেছে, যা আগে সেভাবে সামনে আসেনি।
পৃলিশ বাহিনীর একজন মুখপাত্র ঘটনা স্বীকার করে বিবিসিকে বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় এ ধরনের দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে, যেখানে তৎকালীন পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্য অতিরিক্ত বল প্রয়োগে লিপ্ত হয়েছিলেন এবং আন্দোলনকারীদের নিয়ন্ত্রণে অপেশাদার আচরণ করেছিলেন।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনুসন্ধান চলাকালে ঘটনার এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিডিও বিবিসির হাতে আসে, যেখানে ৫ আগস্ট বিকেলে যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিবর্ষণ শুরুর কিছু মুহূর্ত দেখা যায়। ভিডিওটি এমন একজন আন্দোলনকারীর মোবাইল ফোন থেকে বিবিসি সংগ্রহ করেছে, যিনি নিজেও সেদিন পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান। তাঁর নাম মিরাজ হোসেন। ভিডিওর মেটাডেটা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সেদিন নির্বিচারে গুলিবর্ষণের ঘটনাটি শুরু হয়েছিল দুপুর ২টা ৪৩ মিনিটে। ভিডিওটিতে যাত্রাবাড়ী থানার মূল ফটকে বিক্ষোভকারীদের সামনে সেনাবাহিনীর একটি দলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এরপর হঠাৎ করেই তারা ওই এলাকা থেকে সরে যায়। এ ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই যাত্রাবাড়ী থানার ভেতরের পুলিশ সদস্যরা ফটকের সামনে অবস্থানরত বিক্ষোভকারী জনতার ওপর আকস্মিকভাবে গুলিবর্ষণ শুরু করেন। থানার উল্টো দিকে অবস্থিত একটি ভবনের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, পুলিশ গুলি চালানো শুরু করার পর প্রাণ বাঁচাতে গলির ভেতর দিয়ে ছুটে পালাচ্ছেন বিক্ষোভকারীরা। ওই সময়ের আরেকটি ভিডিওতে আহতদের শরীরে লাথি মারতেও দেখা যায় পুলিশকে।
অনুসন্ধানে বিবিসি দেখেছে, ৫ আগস্ট বিকেলে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে ৩০ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিল। ঘটনার সময়ের কিছু ড্রোন ভিডিও বিবিসির হাতে এসেছে। ভিডিওর মেটাডেটার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিকেল ৩টা ১৭ মিনিটেও যাত্রাবাড়ী থানার সামনের মহাসড়কে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালাচ্ছিল পুলিশ। এরপর তাদের বড় একটি দলকে থানার উল্টো পাশে অবস্থিত একটি অস্থায়ী সেনা ব্যারাকে আশ্রয় নিতে দেখা যায়।
জাতিসংঘের সত্যানুসন্ধান প্রতিবেদন : চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর থেকে প্রকাশিত সত্যানুসন্ধান প্রতিবেদনেও জানানো হয়, গত বছরের জুলাই ও আগস্টের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলন মোকাবেলায় অভিযান পরিচালনায় সরাসরি নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর বাংলাদেশ নিয়ে সত্যানুসন্ধান প্রতিবেদন এবং সুপারিশগুলো অনলাইনের মাধ্যমে ভুক্তভোগী ও অন্যান্য ২৩০ জন বাংলাদেশির সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রণয়ন করেছে। উল্লেখ্য, প্রধান উপদেষ্টার অনুরোধে জাতিসংঘের সত্যানুসন্ধান মিশন গত বছরের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে। সূত্র : বিবিসি ও বিসিসি বাংলাদেশ।